শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৩০ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

মেজর সিনহার কেমন ছিলেন

ভয়েস নিউজ ডেস্ক:

সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। সেনাবাহিনীতে মেজর পদে থাকা অবস্থায় ২০১৮ সালে স্বেচ্ছায় অবসরে যান। চাকরিজীবনে অসম্ভব মেধাবী ও বিচক্ষণ অফিসার ছিলেন সিনহা। তার বাবা অর্থমন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব মোহাম্মদ এরশাদ খান। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ২০০৭ সালে তিনি মারা যান।

তিন ভাই-বোনের মধ্যে সিনহা ছিলেন মেজো। তাদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জে। অবসর গ্রহণের পর থেকে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ ‘জাস্ট গো’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলের জন্য বিভিন্ন ডকুমেন্টরি ভিডিও তৈরির কাজ শুরু করেন। বিশ্বভ্রমণের ইচ্ছা ছিল তার প্রবল। কিন্তু তার সে ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে যায়। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাত ৯টায় কক্সবাজারের টেকনাফে মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি। এই হত্যাকাণ্ড দেশেব্যাপী ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

কে ছিলেন মেজর সিনহা

মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ, বিচক্ষণ, উদ্ভাবনশীল এবং একজন চৌকস স্বাধীনচেতা সেনা অফিসার। তিনি প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্র কর্তৃক ঘোষিত অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স-এসএসএফের সদস্যও ছিলেন। তার জন্ম ১৯৮৪ সালের ২৬ জুলাই। তিনি ১৯৯৯ সালে তিনি ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি এবং ২০০১ সালে রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাস করেন।

২০০৩ সালের ২১ জানুয়ারি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ৫১তম লং কোর্সে যোগ দেন সিনহা। পরবর্তীতে ২০০৪ সালের ২২ ডিসেম্বর তিনি কমিশন লাভ করেন। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি-বিএমএ থেকে ২০০৪ সালে ব্যাচেলর অফ সাইন্স ডিগ্রিতে ফাস্ট ডিভিশনে পাস করেন। চাকরি জীবনে তিনি শ্রেষ্ঠ সঙ্গীন যোদ্ধা (আন্তঃইউনিট সঙ্গীন যুদ্ধ প্রতিযোগিতা-২০০৭), আন্তঃইউনিট বেয়নেট ফাইটিং প্রতিযোগিতা ২০০৭ এর শ্রেষ্ঠ প্রতিযোগী ছিলেন।

২০০৯ সালে সিনহা ক্যাপ্টেন পদে ‘স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের প্রটেকশন কোর্স-৫০’ সম্পন্ন করেন। ২০১১ সালের ১৩ মে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে থেকে ‘ভিআইপি প্রটেকশন কোর্স’ সম্পন্ন করেন। ২০১৩ সালে তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আইভোরি কোস্টে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি এসআই অ্যান্ডটি থেকে ‘বিপিসি-১৯’ কোর্স সম্পন্ন করেন।

২০১৫ সালে সাভারের বাংলাদেশ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং সেন্টার থেকে ‘সিভিল-মিলিটারি রিলেশন অ্যান্ড গুড গভর্ন্যান্স’ সার্টিফিকেট অর্জন করেন। একইবছর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ (বিইউপি) থেকে ‘ওয়ার্কশপ অব ডিজেস্টার অ্যান্ড হিউম্যান সিকিউরিটি ম্যানেজমেন্ট’ সার্টিফিকেট অর্জন করেন। পরের বছর ডিএসসিএসসি থেকে ‘মাস্টার অব সায়েন্স ইন মিলিটারি স্ট্যাডি’ এবং ‘পিএসসি’ কোর্স সফলতার সঙ্গে শেষ করেন।

হত্যার ধরন

২০২০ সালের কোরবানির ঈদের আগের রাতে কক্সবাজারে মেরিন ড্রাইভে তার হত্যার ঘটনা সারা দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে ২০২০ সালের ৩ জুলাই কক্সবাজারের কলাতলী এসেই ওয়ার্ল্ডবিচ রিসোর্টে উঠেন। পরবর্তীতে কক্সবাজারের রামু থানাধীন হিমছড়ির নিলিমা রিসোর্টে ডি-১ নামে একটি কটেজে ওঠেন এবং যথারীতি আশেপাশের চিত্র ধারণসহ বিভিন্ন পেশার লোকজনের জীবন-জীবিকার তথ্য সংগ্রহ ও ভিডিও ধারণ শুরু করেন। এই খবর পৌঁছায় টেকনাফের তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমারের কাছে।

তখন থেকেই ওসি প্রদীপ অধীনস্ত পুলিশ সদস্যদের বলেন, ‘ভিডিও পার্টিকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে, যেকোনো মূল্যে।’ এরপর থেকেই সিনহাকে নজরদারিতে রাখেন পরিদর্শক লিয়াকত ও এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত। ৩১ জুলাই সকালে একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘বৃক্ষরোপণ’ অনুষ্ঠান শেষে ওসি প্রদীপকে জানানো হয়, মেজর সিনহা রাশেদ প্রাইভেটকার নিয়ে টেকনাফের শামলাপুর পাহাড়ে গেছেন।

এ সময় সোর্সের মাধ্যমে বাহারছড়া ক্যাম্পের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী সিনহার ওপর নজর রাখতে থাকেন। শুটিং শেষ করে রাত সাড়ে ৮টায় সিনহা ও তার ভিডিও ধারণের সহযোগী সিফাত পাহাড় থেকে নেমে নিজস্ব প্রাইভেটকারে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দেন। শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে আসার আগে বিজিবি চেকপোস্টে সিনহার গাড়ি তল্লাশির জন্য থামানো হয়। তবে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

৩১ জুলাই রাত নয়টা। টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কে এপিবিএনের চেকপোস্টে থামানো হয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদকে। তখন চেকপোস্টে এপিবিএনের পোশাকে ডিউটিতে ছিলেন একজন কনস্টেবল। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে গাড়ি থামানোর দায়িত্বে ছিলেন। আর আগে থেকেই চেকপোস্টের কাছে সাদা পোশাকে উপস্থিত ছিলেন বাহারছড়া ক্যাম্পের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দলাল রক্ষিত।

এপিবিএনের ওই সদস্য চেকপোস্টে মেজর সিনহার সিলভার রঙের প্রাইভেট কারটি থামার সংকেত দেন। কারটি একটু এগিয়ে গিয়ে থামে। কাছে যান এপিবিএনের ওই সদস্য। পরিচয় জানতে চাইলে সিনহা নিজেকে সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর পরিচয় দেন। এসময় তিনি মেজর সিনহাকে চলে যেতে বলেন।

হঠাৎই পরিদর্শক লিয়াকত দৌঁড়ে এসে গাড়ির চালকের আসনে থাকা ব্যক্তির পরিচয় জানতে চান। ‘ইংরেজিতে’ নিজেকে সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা পরিচয় দেন মেজর সিনহা। এরপরপরই প্রাইভেটকার থেকে প্রথমে নামানো হয় সিনহার ভিডিও ধারণের সহযোগী সিফাতকে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে থাপ্পড় দেওয়া হয় এবং জাপটে ধরে মাটিতে ফেলা দেওয়া হয়, যা করেন চেকপোস্টে থাকা এপিবিএনের সদস্যরা। এই ঘটনা দেখে সিনহা চালকের আসন থেকে দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন।

এ সময় সিনহাকে ‘হাত উঁচু’ করতে বলেই দূর থেকে পরপর দুটি গুলি করেন ইন্সপেক্টর লিয়াকত। সিনহার লাইসেন্স করা পিস্তল তখন গাড়িতেই ছিল। এরপর কাছে এসে আরও দুটি গুলি করেন পরিদর্শক লিয়াকত। এরপর সঙ্গে সঙ্গে মহাসড়কেই লুটিয়ে পড়েন মেজর সিনহা।

সিনহা গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ওসি প্রদীপকে প্রথম ফোন দিয়ে জানান পরিদর্শক লিয়াকত। এর কিছু সময় পরেই পুলিশের গাড়িতে ঘটনাস্থলে আসেন ওসি প্রদীপ। তখন তিনি সাদা পোশাকেই ছিলেন। ঘটনাস্থলে এসে ওসি প্রদীপ সিফাতকে হ্যান্ডকাফ পড়াতে বলেন এবং নাকমুখ দিয়ে পানি ঢালতে থাকেন। এতে সিফাত ভীষণ চিৎকার করতে থাকেন।

হ্যান্ডকাফ না থাকায় প্রদীপ তার সঙ্গে থাকা পুলিশ সদস্যদের গালিগালাজ করতে থাকেন। বলেন, ‘দড়ি দিয়ে বাঁধ। নাকি সেটাও তোদের কাছে নেই?’ এসময় একজন এপিবিএন সদস্য দড়ি খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। ততক্ষণে গুলির শব্দে আশপাশের আরও মানুষ চেকপোস্টের কাছে জড়ো হতে শুরু করে।

শরীরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মেজর সিনহা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাতরাতে থাকেন। তখন ওসি প্রদীপ লিয়াকতকে কিছু একটা বলে সিনহার কাছে যান। প্রথমে বুকে পা দিয়ে পাড়া দেন এবং পা দিয়ে গলা চেপে ধরেন। তখনও নড়াচড়া করছিলেন সিনহা। এর কিছু সময় পরই নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায় তার। এসময় মেজর সিনহার দিকে তাকিয়ে অট্টহাসি দেন ওসি প্রদীপ। বেশকিছু সময় পুলিশের একজন এসআই একটি গাড়িতে করে মেজর সিহনাকে ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নেন।

বিচার প্রক্রিয়া

২০২০ সালের ৩১ জুলাই এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ৫ আগস্ট পুলিশের নয় সদস্যকে অভিযুক্ত করে আদালতে একটি হত্যা মামলা করেন সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার। ৬ আগস্ট আদালতে আত্মসমপর্ণ করেন ওসি প্রদীপ। চার মাস দশ দিন পর কক্সবাজার আদালতে ২৬ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র জমা দেন র‍্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম। অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যার ঘটনাটি ‘পরিকল্পিতভাবে হত্যা’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। অভিযোগপত্রে ১৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে নয়জন টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত পুলিশ সদস্য, তিনজন এপিবিএনের সদস্য এবং তিনজন বেসামরিক ব্যক্তি। আগামীকাল সোমবার এই মামলার রায় ঘোষণা হওয়ার কথা রয়েছে।

ভয়েস/ জেইউ।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION